অনুকরণ সম্পর্কে এরিস্টটল এবং প্লেটোর মতপার্থক্য কি

 অনুকরণ সম্পর্কে এরিস্টটল এবং প্লেটোর মতপার্থক্য কি

অনুকরণ তত্ত্ব কি,অনুকরণ তত্ত্ব,



উপস্থাপনাঃ-

প্লেটো ছিলেন ভাববাদী দার্শনিক। প্লেটোর মতে যে বাস্তব ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পৃথিবীতে আমরা বাস করি সেই পৃথিবী সত্য নয়।এই পৃথিবীর সব কিছুই অনুকরণ। অন্যদিকে প্লেটোর বিপরীতে আছেন এরিস্টটল। এরিস্টটলের কাছে ভাবাদর্শের জগতের কোন অস্তিত্ব ছিল না। তাকে তিনি সত্য বলেও স্বীকার করেননি।

প্লেটো ও এরিস্টটল দু-জনেই বলেছেন শিল্প হল অনুকরণ। কিন্তু শিল্প কিসের অনুকরণ-এই প্রশ্নেই দুজনের মতভেদ সীমাহীন।অনুকরণ সম্পর্কে প্লেটো এবং এরিস্টটলের মানসিকতায় যে মৌল পার্থক্য ছিল সেটাই আমাদের আলোচ্য বিষয়।নিম্নে অনুকরণ সম্পর্কে প্লেটো এবং এরিস্টটলের পার্থক্য আলোচনা করা হলো।


প্লেটো প্রথম থেকেই অনুকরণকে ক্রুটিযুক্ত এবং মিথ্যাচারী বলে ধরে নিয়েছেন।বিশেষ করে নাট্যকার এবং অভিনেতাদের ভয়ংকর মিথ্যচারী বলে মনে করতেন তিনি।কেননা তারা অন্যের ভূমিকায় কথা বলে,অন্যের রূপসজ্জা ধারণ করে।

অন্যদিকে,এরিস্টটল অনুকরণ সম্পর্কে হীনার্থক ধারণা একেবারেই পোষণ করতেন না।পোয়েটিকস গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়ে এই নিয়ে স্বচ্ছ আলোচনা করেছেন।তিনি যা বলেছেন তা সূত্রাকারে এরকম-

অনুকরণ তত্ত্ব কি


ক.❝শৈশব থেকেই অনুকরণ মানুষের স্বাভাবিক বৃত্তি❞।(অনুবাদ শিশির কুমার দাশ) অনুকরণকে তিনি মানুষের সহজাত বৃত্তি বলেছেন যা প্রকৃতই মনস্তত্ত্বসম্মত।


খ. ❝অন্য পশুর থেকে মানুষের সুবিধে হল এই যে সে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি অনুকরণকারী জীব,অনুকরণের মধ্যেই তার শিক্ষার শুরু। ❞[পূর্বোক্ত]


★প্লেটোর সঙ্গে এরিস্টটলের শিল্প সম্পর্কিত অভিমতের আর একটি পার্থক্য ছিল শিল্পীদের মিথ্যাচারেএ ধারণা।

প্লেটো বলেছেন,কবি ও শিল্পীদের অনুকরণ বাস্তবের মানুষ ও ঘটনাবলি থেকে কিছু কিছু সরে আসে।এই সরে আসা তিনি কিছুতেই অনুমোদন করতে পারেননি তাই কবিদের মিথ্যাচারী বলেছেন।

কিন্তু এরিস্টটলের কাছে শিল্প যথাযথ অনুকরণ বলে প্রতিভাত ছিল না।কাব্যতত্ত্ব এর দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে এরিস্টটল বলেছেন কোথাও কোথাও বাস্তব মানুষের চেয়ে সুন্দরতর ও মহত্তর করে কাব্যে বা চিত্রে মানুষকে আঁকা হয়।আবার কোথাও তাদের দেখানো হয় বাস্তব মানুষের চেয়ে হীনতর করে।ট্রাজেডিতে মানুষের মহৎ রূপের প্রকাশ প্রত্যাশিত।কমেডিতে তার অসুন্দর এবং নিম্নতর রূপটি অনেক সময় ফুটে ওঠে।তা ছাড়াও ট্রাজেডির কাহিনিকে আদি-মধ্য-অন্ত যুক্ত সুসংহতি দান করতে গিয়ে বাস্তবের ঘটনাকে কিছুটা ভিন্ন ভাবে বিন্যস্ত করে নিতে হয়।ইতিহাসে যেমন সব ঘটনাকেই স্থান দিতে হয়,ট্রাজেডিতে তেমন দেবার প্রয়োজন নেই।অভিপ্রায় অনুসারে কিছু ঘটনা বর্জন করা যেতে পারে আবার যা বাস্তবে ঘটেনি বা ঘটতে পারে এবং ঘটা সম্ভব তাকেও কাব্যে স্থান দেওয়া যেতে পারে।অর্থাৎ এরিস্টটল অনুকরণ কে মিথ্যাচার বলে ভাবতেই পারেননি।

★শিল্প বিষয়ে প্লেটোর গুরুতর একটি অভিযোগ ছিল নীতি সম্পর্কিত।তিনি বলেছিলেন কাব্যে দেবতাদের চরিত্রকে হীন মনোভাব-সম্পন্ন দেখানো হয়।দেবতাদের নিষ্ঠুরতা,আধিপত্যকামিতা এবং ব্যাভিচার সর্বদাই কবিরা দেখিয়ে থাকেন।রাষ্ট্রশাসকেরা দেবতাদের প্রতিনিধি।দেবতাদের প্রতি আনুগত্য হ্রাস পেলে রাষ্ট্র নেতাদের ও তরুণ সমাজ মান্য করবেনা।যেহেতু প্রাচীন গ্রীসে রাষ্ট্রীয় আনুগত্যই নাগরিকদের অন্যতম কর্তব্য ও নীতি রূপে বিবেচিত হত তাই নাগরিকদের মনে বিদ্রোহের ভাবকে অনৈতিক মনে করেছেন প্লেটো।

অন্যদিকে এরিস্টটল বলেছেন,শিল্প জাগতিক বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত কোন বস্ত নয়।শিল্প হলো শিল্পীর নিজস্ব সৃষ্টি। কাজেই বাস্তব জগতের নৈতিকতার আদর্শ সব সময় শিল্পের জগতের নৈতিকতার সম মাত্রায় বিবেচিত হতে পারেনা।স্পষ্ট করে না বললেও এরিস্টটল এর কথা থেকে বোঝা যায়,সাধারণ মানুষ বাস্তবের নীতি আর শিল্পের নীতিকে এক মানদণ্ডে গ্রহণ করে না


প্লেটোর মতে,সকল শিল্প সৃষ্টির মূলাকরণ হলো অনুকরণ। আর এই অনুকরণের পেছনে ঈশ্বরের অনুপ্রেরণা কাজ করে থাকে। অর্থাৎ সকল শিল্পী সাহিত্যিকেরা ঈশ্বরের অনুপ্রেরণায় অনুকরণ করে থাকেন,শিল্প সৃষ্টি করে থাকেন।

কিন্তু এরিস্টটলের মতে, 'অনুকরণ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি।'মানুষ অনুকরণ প্রিয় জীব।অনুকরণের প্রেরণা বা আকাঙ্ক্ষা মানুষের মস্তিষ্কের মধ্যেই নিহিত।মানুষ সৌন্দর্য পিপাসু জীব। সৌন্দর্য মানুষকে আকৃষ্ট করে।এ জন্য মানুষ অনুকরণ করে থাকে।তিনি সাহিত্যকে অনুকরণ করার জন্য তিনটি পন্থা অবলম্বন করেছেন।যথাঃ-

  • অনুকরণের বিষয়
  • অনুকরণের মাধ্যম
  • অনুকরণের পদ্ধতি



প্লেটোর মতে,ঈশ্বর Absolte Idea থেকে জগৎ সংসার সৃষ্টি করেছেন। Idea-!কে দেখতে হয় একটা বোধের মধ্য দিয়ে।আর এই বোধের মাধ্যমেই ঈশ্বর জগৎ সংসার সৃষ্টি করেছেন।ঈশ্বরের অনুকৃত প্রকৃতিকেই কবি-সাহিত্যিকগন অনুকরণ করেন।সুতরাং কাব্য বা শিল্প সাহিত্য সত্য থেকে তিনধাপ দূরে।

এরিস্টটলের মতে,কাব্য বা শিল্প সাহিত্য সত্য থেকে তিন ধাপ দূরে নয়।প্রত্যক্ষ জগৎ সত্য এবং তাকে কেন্দ্র করে কবি বা শিল্পীরা সৃষ্টিশীল প্রতিভার মাধ্যমে কাব্য বা শিল্প রচনা করে থাকেন।সুতরাং শিল্প বা কাব্য সত্য।



সুতরাং উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে,প্লেটো প্রথম Mimesis তত্ত্বের প্রণেতা এবং এরিস্টটল প্লেটোর শিল্পতত্ত্বকে নতুন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা বিচার করে আরো সহজ ও সুন্দর করে তুলেছেন যা ইউরোপে বহু শতাব্দী ধরে সেই আদর্শই একমাত্র সাহিত্যাদর্শ বলে গৃহীত হয়েছে। 

কোন মন্তব্য নেই

Barcin থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.