মহাকাব্য ও ট্রাজেডি কি? মহাকাব্য এবং ট্রাজেডির মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য আলোচনা করো।

 মহাকাব্য ও ট্রাজেডি কি? মহাকাব্য এবং ট্রাজেডির মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য আলোচনা করো। 

মহাকাব্য ও ট্রাজেডি কি


প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যের দুটি প্রধান ধারা হচ্ছে মহাকাব্য ও ট্রাজেডি।মহাকাব্য ও ট্রাজেডি প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। ট্রাজেডির পর  অ্যারিস্টোটল তাঁর কাব্যনির্মাণ তত্ত্বে গুরুত্ব দিয়েছেন মহাকাব্যের উপর।এরিস্টটল কাব্যতত্ত্ব গ্রন্থের ৫ম,২৩তম,২৪তম ও ২৬তম পরিচ্ছেদে মহাকাব্য সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।একই সাথে তিনি মহাকাব্য ও ট্রাজেডি সম্পর্কে তুলনামূলক আলোচনা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে এই দুটি বিষয় সম্পূর্ণ আলাদা।

পোয়েটিকস এর পঞ্চম অধ্যায় সহ আরো বিভিন্ন স্থানে মহাকাব্যের বিষয়াদি উত্থাপিত এবং আলোচিত হয়েছে। এতদসত্ত্বেও এরিস্টটল মহাকাব্যের কোন সংহত সংজ্ঞা প্রদান করেননি যেমন করেছেন ট্রাজেডি সম্পর্কে। বরং ট্রাজেডির সঙ্গে তুলনা প্রসঙ্গে মহাকাব্যের নানা গুণ বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ পাওয়া যায় পোয়েটিকসে।মহাকাব্য কে হতে হবে বর্ণনাত্মক, একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ক্রিয়া কে ভিত্তি করে নাটকীয় রীতিতে মহাকাব্যের কাহিনী বিকশিত হবে। তার থাকবে আদি, মধ্য ও অন্ত।সমস্ত কাহিনির মধ্যে থাকবে একটি জৈব ঐক্য  আর তার আনন্দ হবে বিশিষ্ট। 

মহাকাব্যের সাথে ট্রাজেডির যেমন সাদৃশ্য আছে,তেমন বৈসাদৃশ্য ও আছে।এরিস্টটলের কাছে ট্রাজেডি কাব্যের শ্রেষ্ঠতম রূপকল্প।আবার মহাকাব্য কে ও তিনি ট্রাজেডির আলোকে বিচার করেছেন।নিম্নে মহাকাব্য ও ট্রাজেডির সংজ্ঞা এবং উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য তুলে ধরা হলো।


মহাকাব্য ও ট্রাজেডি কাকে বলে?


মহাকাব্য সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা অ্যারিস্টটল তাঁর পোয়েটিকস কাব্যগ্রন্থে দেননি। তবে মহাকাব্য সম্পর্কে তাঁর প্রদত্ত বিভিন্ন ধারণা আলোকে বলা যায় যে, যে কাব্য পরিসরে বিশাল ও বিস্তৃত বর্ণনাত্মক  রীতিতে রচিত, বিষয়ের অনুকরণে গম্ভীর ও গভীর এবং কর্মকাণ্ডের দিক থেকে মননশীল সেই কাব্যকে মহাকাব্য বলা যেতে পারে। 


 ট্রাজেডির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে এরিস্টটল বলেন, "ট্রাজেডি হলো একটি গম্ভীর, সম্পূর্ণ ও বিশেষ আয়তন বিশিষ্ট ক্রিয়ার অনুকরণ, ভাষার সৌন্দর্যে তার প্রতিটি অঙ্গ স্বতন্ত্র, এই ক্রিয়াটির প্রকাশরীতি বর্ণনাত্মক নয়, নাটকীয়, আর এ ক্রিয়া ভীতি ও করুণার উদ্রেক করে এবং তার মধ্য দিয়ে অনুরূপ অনুভূতিগুলোর পরিশুদ্ধি ঘটায়। "



মহাকাব্য ও ট্রাজেডির সাদৃশ্য গুলি কী কী?


  • ক)মহাকাব্য এবং ট্রাজেডি দুই ই গঠিত হয় এমন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ঘটনাকে অবলম্বন করে, যার থাকবে আদি, মধ্য ও অন্ত ভাগ। 
  • খ)মহাকাব্য ও ট্রাজেডি দুটিতেই উপকাহিনি থাকতে পারে এবং থাকে।


  • গ)মহাকাব্য এবং ট্রাজেডি উভয় ক্ষেত্রেই কবিরা বহু ঘটনার মধ্য থেকে কিছু ঘটনা নির্বাচন করে নেন। তারপর সেগুলো যথাযথ ভাবে বিন্যস্ত করে কাহিনীর মধ্যে অখন্ডতা সৃষ্টি করেন। অত্যন্ত সুনির্মিত মহাকাব্য হিসেবে অ্যারিস্টোটল হোমার এর ইলিয়াড এবং ওডিসির উল্লেখ করেছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন- "কিন্তু হোমার সমগ্র ট্রয় যুদ্ধের কাহিনী কে তার কাব্যের বিষয়বস্তু করেননি কারণ বিষয়টা অত্যন্ত বড়, তার অখন্ডতা সৃষ্টি করা সহজ নয়, আর যদি তা সম্ভবও হয় তাহলেও অসংখ্য ছোট ছোট ঘটনার ভারে তা অত্যন্ত জটিল হয়ে যাবে।সেজন্য তিনি এই (বিরাট কাহিনি থেকে) একটি অংশ বেছে নিয়েছেন,যদিও অন্যান্য বহু ঘটনাকে তিনি উপকাহিনী হিসেবে ব্যবহার করেছেন।


  • ঘ)ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদেই এরিস্টটল বলেছেন যে,মহাকাব্য এবং ট্রাজেডি উপভোগের যে আনন্দ তা হবে বিশেষ ধরনের। ভয় এবং করুণা জায়গায় এমন অনুভব থেকে শিল্প উপভোগের যে চরিতার্থতার বোধ জাগে তাই মহাকাব্য এবং ট্রাজেডি উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। 


মহাকাব্য ও ট্রাজেডির মধ্যে বৈসাদৃশ্য গুলো কী কী?

মহাকাব্য এবং ট্রাজেডির মধ্যে ঐক্যের চেয়ে অনৈক্যই বেশি পরিলক্ষিত হয়।যে সকল ক্ষেত্রে সেসব বৈসাদৃশ্য দেখা যায় তা হচ্ছে-

১)কাহিনির দৈর্ঘ্যঃ

অ্যারিস্টোটলের মতে ট্রাজেডি এবং মহাকাব্যের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হচ্ছে কাহিনির দৈর্ঘ্য। ট্রাজেডির আয়তন হয় নির্দিষ্ট এবং সুসংবদ্ধ। কাহিনির আরম্ভ ও শেষ যেন একইসঙ্গে গোচরীভূত হয়। মহাকাব্যে কাহিনী সে তুলনায় অনেক দীর্ঘ হতে পারে। তার কারণ নাটকে সমকালে সংঘটিত  অনেক ঘটনা একই সঙ্গে দেখানো সম্ভব নয়। কারণ রঙ্গমঞ্চে এককালে একটি ঘটনার অভিনয়ই সম্ভব।কিন্তু মহাকাব্য যেহেতু বর্ণনাত্মক সেজন্য একই সময়ে ঘটছে এমন অনেক ঘটনা সেখানে বর্ণিত হতে পার,  তার ফলে কাহিনীর আয়তনে আসে বিস্তৃতি । 

খ)ছন্দঃ 

মহাকাব্য ও ট্রাজেডির মধ্যে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যের ক্ষেত্রটি হল ছন্দ ব্যবহার। মহাকাব্যের ছন্দ হবে 'শূরছন্দ' বা 'ষটপদী'।ইংরেজিতে একে হিরোয়িক কাপলেট বলা হয়।এরিস্টটল বলেছেন - "যদি অন্য কোন এক বা একাধিক ছন্দে কেউ মহাকাব্য রচনা করতে চান তার ফল তৃপ্তিকর হবে না।শূরছন্দই সবচেয়ে গম্ভীর, সবচেয়ে রাজকীয়,এর মধ্যেই অপরিচিত শব্দ ও রূপক ব্যবহারের স্বাচ্ছন্দ্য সবচেয়ে বেশি-আর এই ব্যপারে বর্ণনাত্মক কাব্য অন্য সব কাব্যের চেয়ে বেশি ব্যাপক।"

অপরদিকে, ট্রাজেডিতে একাধিক ছন্দ ব্যবহার করা হয়,কারন সেখানে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির সংলাপ।



ট্রাজেডি কাকে বলে বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন



গ)সংগীত ও দৃশ্যঃ

সংগীত ও দৃশ্য এমন দুটি উপাদান যা কেবল ট্রাজেডিতে পাওয়া যায়, মহাকাব্যে নয়। সংগীত ও দৃশ্য থাকার কারনে ট্রাজেডির আনন্দ মহাকাব্যের তুলনায় অনেক বেশি ঘনীভূত হয়।


ঘ)উপাদানগতঃ

মহাকাব্য এবং ট্রাজেডির শেষ বৈসাদৃশ্য হচ্ছে উপাদানগত। বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যে, মহাকাব্যের সকল উপাদান ট্রাজেডিতে বিদ্যমান। অন্যদিকে ট্রাজেডির সকল উপাদান মহাকাব্যে নেই। এদিক থেকে বিচার করলে ট্রাজেডি অবশ্যই উৎকৃষ্ট বলা যায়। 


*মহাকাব্য ও ট্রাজেডির মধ্যে উল্লেখিত আলোচনার পরেও আরেকটি প্রশ্ন থেকে যায় মহাকাব্য না ট্রাজেডি কোনটি শ্রেষ্ঠ? এ প্রশ্নের জবাব এরিস্টটল নিজেই দিয়েছেন দুভাবে।


  • প্রথমত,তিনি বলেছেন মহাকাব্যের আবেদন উচ্চশ্রেণীর শ্রোতাদের কাছে সেখানে অভিনেতাদের অঙ্গভঙ্গির প্রয়োজন নেই। আর ট্রাজেডির আবেদন নিম্ন শ্রেণির শ্রোতাদের কাছে। সুতরাং ট্রাজেডি যদি নিকৃষ্ট শ্রোতাদের জন্য হয় তাহলে মহাকাব্য অবশ্যই উন্নততর শিল্প।



  • দ্বিতীয়ত, ট্রাজেডি যদি সব দিক থেকে এবং শিল্পগত আবেদনেও উন্নততর হয়,আর শিল্পের যে বিশেষ আনন্দের কথা আমরা বলেছি সেই আনন্দ যদি দেয়,তাহলে স্পষ্টতই  ট্রাজেডি যেহেতু মহাকাব্যের চেয়ে উন্নততর আনন্দ দেয়,ট্রাজেডিই  উৎকৃষ্টতর শিল্প।


উপর্যুক্ত বক্তব্য দুটি থেকে আমরা দুটি বিষয়ের উপর দৃষ্টি দিতে পারি।একটি হচ্ছে শ্রোতা অন্যটি হচ্ছে আনন্দ।সুতরাং আনন্দ উন্নত শ্রোতাদের কাছে থাকবে এবং যেটি উন্নত আনন্দ দেবে সেটিই উৎকৃষ্ট। এমনিতে কোনটি শ্রেষ্ঠ বা অশ্রেষ্ঠ নয়। 

আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে,ট্রাজেডি এবং মহাকাব্য দুটি উন্নত সাহিত্য ধারা।তবে ট্রাজেডি মহাকাব্যের চেয়ে উন্নততর।



ট্যাগঃ 

মহাকাব্য কি , ট্রাজেডি কি , 

ট্রাজেডির সাদৃশ্য , ট্রাজেডি , মহাকাব্য 

কোন মন্তব্য নেই

Barcin থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.