বাইনাল কাসরাইন (প্যালেস ওয়াক) পার্ট-২
বাইনাল কাসরাইন (প্যালেস ওয়াক) অনুবাদ পার্ট-২
আরবি থেকে বাংলা অনুবাদ করা
সে অনুগত হয়ে গেছে এবং স্বামীর আনুগত্যে নিজেকে এমনভাবে
বিলিয়ে দিয়েছে যে, তার অগোচরেও তার নৈশালাপের নিন্দা করতে সে অপছন্দ করত।
সে মনে মনে মেনে নিয়েছিল যে, প্রকৃত পুরুষত্ব,
স্বেচ্ছাচারিতা বা কঠোর আচরণ ও মধ্য রাতের পরও রাতজাগা মূলসত্ত্বার অবশ্যম্ভাবী
গুণ। কাল পরিক্রমায় সে এত পাল্টে গেল যে স্বামীর থেকে প্রকাশ পাওয়া সব কিছু নিয়েই
সে গর্ব করত, চাই তা তার জন্য আনন্দদায়ক হোক বা বিষাদময়। এভাবে সে (দাম্পত্য
জীবনের) সকল অবস্থাতেই একজন প্রেমিকা, অনুগত ও আত্মসমর্পণকারী স্ত্রী হয়ে গেল।
আত্মসমর্পণ ও শান্তি কামনা, যা সে খুশি মনে মেনে নিয়েছে—
তার ব্যাপারে সে কোনো দিন আফসোস করে নি। বরং যখনই সে দিনগুলির স্মৃতিচারণ করত,
তখনই তার মনে ভালো ও সুখকর বিষয়গুলো ছাড়া আর কিছু আসত না। ছায়ামূর্তি ও জনশূন্য
বাড়ির মত ভয় ও দুশ্চিন্তার বিষয়গুলো মনে হলে শুধু একটি জীর্ণ হাসি হাসা ছাড়া আর
কিছুই সে করত না।
তার স্বামীর দোষ থাকা সত্ত্বেও সিকি শতাব্দী ধরে সে কি তার সাথে
বসবাস করে নি? তার সাথে মেলামেশা করে সে পেয়েছে চোখের মণিতুল্য সন্তানাদি এবং
সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, কল্যাণ ও প্রাচুর্যে ভরপুর একটি বাড়ি? হ্যাঁ, সে বসবাস করেছে।
আর প্রেতাত্মাদের সাথে মেলামেশার রাতগুলো সেভাবেই অতিক্রান্ত হয়েছে, যেভাবে
প্রতিটা রাত শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে অতিক্রান্ত হয়। কখনো তার সন্তানদের প্রতি
প্রেতাত্মাদের হাত প্রসারিত হয় নি। আল্লাহ না করুক! যা হয়েছে তা সবই কৌতুক ও
হাস্যরসের কাছাকাছি। সুতরাং অভিযোগের কোনো সুযোগ নেই, সমস্ত প্রশংসা ঐ আল্লাহর
জন্য যার পবিত্র কালামের বদৌলতে তার অন্তর প্রশান্ত হয়েছে এবং যার অনুগ্রহে তার
জীবন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সে তার অপেক্ষার সময়টাকে মনের গহীন থেকে ভালোবাসত, যদিও তা
তার সুখ-নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটাত এবং যে কাজগুলো দিনশেষে সম্পন্ন হওয়ার কথা সেগুলো
(গভীর রাতে বাধ্য হয়ে) করতে হত। অধিকন্তু এটা তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত
হয়েছিল এবং তার প্রচুর স্মৃতির সাথে জড়িয়ে গিয়েছিল।
স্বামীর প্রতি অনুরাগ, তাকে সুখী করার জন্য আত্মত্যাগ এবং
রাতের পর রাত এই মায়া-মহব্বত ও আত্মবিসর্জনের ফলে সৃষ্ট অনুভূতির কারণে সে
জীবন্ত-কিংবদন্তি হয়েছিল এবং এখনও আছে। এ জন্য সে প্রশান্তিতে ভরপুর হয়ে বেলকনিতে
দাঁড়িয়ে গ্রীলের ছিদ্র দিয়ে একবার বাইনাল কাসরাইনের রাস্তার দিকে তাকায়, তো
আরেকবার খুরুনপুশের রাস্তার মোড়ের দিকে, আরেকবার বাদশাহর গোসলখানার সদর দরজার
দিকে, তো চতুর্থবার মিনারগুলোর দিকে দৃষ্টি ফেরায়। আবার কখনো সে দৃষ্টি ঘুরায়
রাস্তার দুই পাশের অবিন্যস্ত বিশৃঙ্খল এলোমেলো ঘরগুলোর দিকে, যেগুলো নিয়ম-শৃঙ্খলার
কঠোরতামুক্ত বিশ্রামের বিরতিতে থাকা সেনাবাহিনীর সারির মত (এলোমেলোভাবে) দাঁড়িয়ে
আছে।
সে প্রিয় দৃশ্যটি দেখে মুচকি হাসে। (সেই প্রিয় দৃশ্যটি হলো
সে রাস্তার,) যে রাস্তা ফজর ফজর অবধি ঘুমায় না, যখন অন্য সব রাস্তা, অলিগলি ঘুমে
(বিভোর) থাকে। কতবার যে এটা (রাস্তা) তার অনিদ্রাকে ভুলিয়ে দিয়েছে, তার নিঃসঙ্গতায়
সঙ্গ দিয়েছে, মন থেকে ভয় বিদূরিত করে দিয়েছে! চারপাশের এলাকাকে গভীর নীরবতায়
ডুবিয়ে দেওয়া ছাড়া রাত আর কোনো পরিবর্তন আনে না। বরং তার আওয়াজগুলোর জন্য এমন এক
পরিবেশ তৈরি করে যেখানে আওয়াজগুলো আরো উঁচু ও স্পষ্ট হয়, ঠিক যেমন কাষ্ঠফলকের
প্রান্তদেশে ছায়ার আঁচড়ের ফলে চিত্রটা আরো গভীর ও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এ (নিঝুম রাতের নীরবতার) কারণে হাসির ধ্বনি এমনভাবে অনুরণিত
হয়, যেন হাসিটা তার রুম থেকেই ছড়িয়ে পড়ছে। স্বাভাবিক (কণ্ঠের) কথাবার্তাও সে শুনে
শব্দ শব্দ আলাদা করতে পারে।
(কারো) কাশি ছড়িয়ে পড়লেও, সে শুনতে পায়; এমনকি তা
প্রবল থেকে শেষ হয়ে মৃদু গোঙানির আওয়াজের মত হলেও তার দিকে ভেসে আসে। পরিচারক বা খানসামার
আওয়াজ তার নিকট মুয়াজ্জিনের আওয়াজের মত ভেসে আসে যখন সে বলে, “বৈঠক দীর্ঘজীবী
হোক”। মহিলা তখন হেসে বলে, “হায়রে মানুষ! এই সময়েও বৈঠকের দীর্ঘায়ু কামনা করে!”
(তাদের আওয়াজ শোনার পর) তাদের সাথে তার স্বামীর কথাও মনে
পড়ল তার। সে বলতে লাগল, “কি মনে হয়, এখন আমার স্বামী কোথায় থাকতে পারে? তিনি এখন
কী করছেন? ... তিনি যেখানেই থাকুক না কেন, প্রবাসে-নিবাসে সর্বাবস্থায় নিরাপত্তা
তার সঙ্গী হোক!”
অবশ্য তাকে এক সময় বলা হয়েছিল যে, আহমদ-আব্দ-আল-জাওয়াদের মত
এমন বিত্তবান, সুদর্শন ও শক্তিশালী পুরুষ, যিনি কিনা রাতের পর রাত নৈশালাপে কাটান,
তার জীবনে অন্য কোনো নারী থাকবে না, তা হতে পারে না। তখন (তার জীবন)
আত্মমর্যাদায়/ঈর্ষায় বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল এবং গভীর দুঃখ তাকে ভর করেছিল। এ
ব্যাপারে স্বামীর সাথে কথা বলার সাহস তার হয়নি বলে, সে তার প্রচণ্ড দুঃখের কথা তার
মাকে জানিয়েছিল।
অতঃপর মা মিষ্টি কথা বলে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
“সে তার প্রথম স্ত্রীকে তালাক দিয়ে তোমাকে বিয়ে করেছে। সে
চাইলে তাকেও ফিরিয়ে আনতে পারত অথবা তোমাকে রেখে দ্বিতীয়, তৃতীয় এমনকি চতুর্থ
স্ত্রী গ্রহণ করার সামর্থ্যও তার আছে। তাছাড়া তার বাবার অনেক স্ত্রী ছিল। সুতরাং
সে যে তোমাকে এখনও স্ত্রী হিসেবে রেখেছে, তার জন্য রবের প্রশংসা করো।”
যদিও কঠিন মুহূর্তের প্রচণ্ড দুঃখের সময় তার মায়ের কথা তার
কোনো কাজে আসেনি, তবুও শেষ পর্যন্ত সময়ের সাথে সাথে সত্যতা ও যথার্থতার কারণে
(মায়ের কথা) মেনে নিয়েছে সে। আর তাকে যা বলা হয়েছে, তা যদি সত্যও হয়, তাহলে
নৈশালাপ, স্বৈরাচারী আচরণেল মত এটাও হয়তো তার পুরুষত্বের একটা বৈশিষ্ট্য। যে কোনো
বিচারে একটি অনিষ্ট অনেক অনিষ্ট থেকে ঢের ভালো। সুতরাং এটা তার জন্য সহজ নয় যে,
কারো একটি কুমন্ত্রণা ও গুজব কানে নিয়ে নিজের সুখ ও প্রাচুর্যে ভরা পবিত্র
জীবনটাকে নষ্ট করে দিবে।
আরবি শিখুন অনলাইনে ফ্রি আরবি ভাষা ও ব্যাকরন শিখতে এখানে ক্লিক করুন ।
তাছাড়া হয়তো যা বলা হয়েছিল তা সম্পূর্ণ ধারণাপ্রসূত ও
বানোয়াট। সে অনুভব করল যে তার ঈর্ষাপূর্ণ/আত্মমর্যাদার অবস্থানটা জীবনের অন্যান্য
কষ্টক্লেশে পূর্ণ সমস্যার মত যা অনিবার্য ভাগ্য হিসেবে মেনে নিতে হবে এবং বিপরীতে
কিছু করার ক্ষমতা সে রাখে না। তাই তা প্রতিহত করতে সে কেবল ধৈর্যকে আহ্বান করল এবং
ব্যক্তিত্বের প্রতিরোধ ক্ষমতার সাহায্য নিল; যা তিনি অপছন্দ করেন তা ঠেকাতে এটাই
তো তার একমাত্র আশ্রয়স্থল। ফলে স্বামীর অন্যান্য স্বভাব, প্রেতাত্মাদের সাথে
মেলামেশার মত ঈর্ষা/আত্মমর্যাদাবোধ বা এ সংশ্লিষ্ট ভাবনাগুলো তার কাছে সহনীয় রূপ
নিল।
সে রাস্তার দিকে তাকিয়ে নৈশ আলাপকারীদের আওয়াজ শুনছিল। তখন
তার কাছে ভেসে এল ঘোড়ার খুর পতনের শব্দ। (খুরের আওয়াজ শোনার পর) সে আন-নাহাসিন
(তামাপট্টির) সড়কের দিকে নিজের মাথাটা ঘুরালো এবং দেখতে পেল হানতুর (এক প্রকার
ঘোড়ার গাড়ি) ধীরে ধীরে নিকটবর্তী হচ্ছে এবং তার বাতি দুটি অন্ধকারে জ্বলজ্বল করচে।
তখন সে স্বস্তি ও প্রশান্তির দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বলল, “অবশেষে....”। এই হলো তার কোনো এক বন্ধুর
হানতুর (নিচু ঘোড়ার গাড়ি) যা তাকে রাত জাগার পর বাড়ির সদর দরজায় পৌঁছে দিয়ে
প্রতিদিনকার মত তার মালিক ও এলাকায় বসবাসকারী বন্ধুদের নিয়ে খুরুনপুশ বা গলিপথের
দিকে চলে যায়।
গাড়িটি বাড়ির সামনে দাঁড়াল। অতঃপর হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে তার
স্বামীর আওয়াজ উঁচু হলো এবং সে বলল, “তোমাদের বিদায় জানাচ্ছি!”
সে (দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে) তার স্বামীর আওয়াজ শুনছিল, যখন সে
(তার স্বামী) আন্তরিকতা ও উৎসাহের সাথে তার বন্ধুদের বিদায় জানাচ্ছিল। (এমন
আন্তরিকতাপূর্ণ ধ্বনি) যদি সে প্রতি রাতে না শুনত, তাহলে সে তা অস্বীকার করে বসত।
সে ও তার সন্তানেরা শুধু তার দৃঢ়তা, গাম্ভীর্য ও রাশভারী স্বভাবের সাথেই পরিচিত
ছিল। এ সময়টাতে এসব কৌতুকপূর্ণ ও হাস্যরসাত্মক কথাবার্তা কোত্থেকে আসে যা কোমলতা ও
প্রফুল্লতা প্রবাহিত করে?
গাড়ির মালিক তার সাথে কৌতুক করে বলল, “গাড়ি থেকে নামার পর
ঘোড়া নিজে নিজেকে কী বলেছে, তা-কি আপনি শুনে নি?” সে (ঘোড়া) বলেছে, “এটা খুবই
আফসোসের ব্যাপার যে, আমি এই লোকটাকে প্রতি রাতে তার বাড়িতে পৌঁছে দিই, অথচ সে কেবল
গাধার আরোহণ করারই যোগ্য।”
গাড়ির লোকগুলো ফেটে পড়ল হাসিতে। সাইয়েদ তাদের হাসি থামার
জন্য অপেক্ষা করলেন। এরপর সে কথাটির উত্তরে বললেন,
“তুমি কি শুনো নি, সে মনে মনে কী উত্তর দিয়েছে?” সে বলেছে,
“যদি তুমি (ঘোড়া) পৌঁছে না দাও, তাহলে বেক সাহেব আমাদের মালিকের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে
আসবেন।”
গাড়ির লোকেরা আবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। অতঃপর গাড়ির মালিক
বললেন, “বাকিটা আমরা আগামীকালের নৈশালাপের জন্য রেখে দিই।”
গাড়িটি বাইনাল কাসরাইনের রাস্তার দিকে চলতে লাগল এবং সাইয়েদ
সাহেব দরজাভিমুখী হলেন। মহিলা বেলকনি ছেড়ে চলে এল রুমে। তারপর বাতি হাতে নিয়ে
ড্রইং রুমের দিকে গেল। আর সেখান থেকে বাহিরের করিডোরে গিয়ে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়াল।
বাইরের দরজা বন্ধ করার শব্দ ও খিল আঁটার আওয়াজ তার কানে
ভেসে এল। তার কাছে মনে হল যে, তার স্বামী দীর্ঘ কায়া নিয়ে অতিক্রম করছে; ভীতি ও
গাম্ভীর্য ফিরিয়ে এনে এবং সেই প্রমোদের ভাব ঝেড়ে, যা সে যদি নিজ কানে চুপিসারে না
শুনত, তাহলে তার কাছে ব্যাপারটা অসম্ভব ঠেকত। তারপর সে সিঁড়ির স্তরের উপর স্বামীর
ছড়ির অগ্রভাগ পতনের আওয়াজ শুনতে পেল। তার জন্য রাস্তা আলোকিত করতে রেলিংয়ের উপর
থেকে বাতিসহ হাত বাড়িয়ে দিল।
লোকটি সিঁড়ি (ডিঙিয়ে) তার (স্ত্রীর) দাঁড়ানোর স্থানে এসে
পৌঁছলেন। সে বাতিটা উপরে তুলে ধরে তার সামনে যেতে থাকে। তিনি তাকে (স্ত্রীকে)
অনুসরণ করে যাচ্ছেন আর বিড়বিড় করে বলছেন, “শুভ সন্ধ্যা, হে আমেনা।”
সেও শিষ্টাচার ও নম্রতা প্রকাশ করে নিচুস্বরে বলল, “শুভ
সন্ধ্যা, হে আমার মনিব।”
ইত্যবসরে রুম তাদের দুজনকে শামিল করল (অর্থাৎ তারা রুমে
প্রবেশ করল)। অতঃপর আমিনা বাতিটা রাখার জন্য ডাইনিং টেবিলের দিকে গেল। তখন সাইয়েদ
সাহেব তার ছড়িটা খাটের জানালার কিনারায় ঝুলিয়ে রাখলেন। ফেজ টুপিটা খুলে সোফার মাঝ
বরাবরে থাকা কুশনের উপর রাখলেন। অতঃপর স্ত্রী তার জামা খুলে দিতে তার নিকটবর্তী
হল। দাঁড়ানো অবস্থায় তার দীর্ঘ কায়া, চওড়া দুই কাঁধ, বড় টাইট ভূঁড়ি বিশিষ্ট বিশাল
শরীর প্রকাশিত হল। তার পুরো শরীরকে আবৃতকারী একটি চমৎকার ও ঝলমলে আচকান ও চাপকান
তার রুচির বিলাসিতা ও উদারতা প্রকাশ করছে। আর সিঁথি থেকে মাথার দুপাশে ছড়ানো
পরিপাটি করে সাজানো কালো চুল, বড় হীরক পাথরওয়ালা আংটি ও সোনার ঘড়ি কেবল তার রুচির
বিলাসিতা ও উদারতাকেই নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করছে।
লম্বাটে গড়নের, ভাঁজহীন ত্বকবিশিষ্ট, অভিব্যক্তি প্রকাশক ও
স্পষ্ট অবয়বের মুখমণ্ডল তার প্রশস্ত নীলাভ চক্ষুযুগল, চেহারার প্রশস্ততার সাথে
সামঞ্জস্যপূর্ণ উঁচু বড় নাক, মাংসল (পুরু) ঠোঁটবিশিষ্ট চওড়া মুখ ও অত্যন্ত
যত্নসহকারে উভয় দিকে পাকানো ঘন কালো গোঁফ সামগ্রিকভাবে তার সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্ব
প্রকাশ করছে।
স্ত্রী তার কাছে এলে তিনি তার দুই বাহু ছড়িয়ে দিলেন। সে
(স্ত্রী) তার আচকান খুলে দিয়ে যত্নসহকারে ভাঁজ করে সোফার উপর রাখল। আবার তার কাছে
ফিরে এসে চাপকানের ফিতা খুলল। তারপর তা টান দিয়ে খুলে আচকানের উপরে রাখার জন্য
যত্নসহকরে ভাঁজ করল। সাইয়েদ সাহেব ততক্ষণে ঢিলা জামাটা গায়ে দিয়ে সাদা টুপিটা পরে
নিলেন। হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে তিনি সোফায় বসলেণ। দেয়ালে মাথাটা ঠেস দিয়ে পা দুটো
(পায়ের নলা) সামনের দিকে ছড়িয়ে দিলেন। জামাগুলো গোছানোর পর তার স্ত্রী তার ছড়িয়ে
দেওয়া পায়ের কাছে বসে জুতা ও মোজা খুলতে শুরু করল। (মোজা খোলার পর) যখন তার ডান পা
অনাবৃত হল, তখনই এই বৃহৎ সুন্দর শরীরে প্রথম দোষটা ঐ অনামিকা আঙুলে প্রকাশ পেল, যা
পুরাতন ক্ষতের জায়গায় খুরের অনবরত ঘষার কারণে ক্ষয় হয়ে গেছে।
আমেনা কামরা ত্যাগ করে কিছুক্ষণের জন্য অদৃশ্য হল। ফিরে এল
ছিলমচি ও বদনা নিয়ে। ছিলমচিটা তার দুই পায়ের মাঝখানে রেখে বদনা হাতে প্রস্তুতির
ভঙ্গিতে দাঁড়াল। সাইয়েদ সোজা হয়ে বসে হাতটা প্রসারিত করে দিলেন। (স্ত্রী) পানি
ঢেলে দিলে তিনি মুখ ধুয়ে মাথা মাসেহ করলেন এবং লম্বা কুলি করলেন। অতঃপর সোফায় ঠেস
দেওয়ার জায়গা থেকে তোয়ালেটা নিয়ে মাথা, মুখ ও দুই হাত শুকাতে লাগলেন। আর তখন
স্ত্রী ছিলমচিটা নিয়ে গোসলখানার দিকে চলে গেল। আঞ্জাম দেওয়া এ বিশাল বাড়ির অনেক
দায়িত্বের মধ্যে এটিই তার সর্বশেষ দায়িত্ব। সিকি শতাব্দী ধরে সোৎসাহে দায়িত্বটি
পালন করে যাচ্ছে সে। তাকে কোনো ধরনের ক্লান্তি পেয়ে বসে না, সে আনন্দ ও প্রফুল্লতা
নিয়ে কাজটা করে এবং সেই একই উদ্যম নিয়ে কাজটা করে যা তাকে সূর্যোদয়ের পূর্ব থেকে
সূর্যাস্ত পর্যন্ত বাড়ির সমস্ত কাজ করতে উদ্দীপ্ত করে। ফলে প্রতিবেশী মহিলারা তার
সীমাহীন পরিশ্রম ও কর্মতৎপরতার কারণে তাকে ‘মৌমাছি’ ডাকার বিষয়টা তার জন্য উপযুক্ত
হয়েছে।
মহিলা তার রুমে ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে দিল এবং খাটের নিচ
থেকে মাদুর বের করল। তারপর সোফার সামনে রেখে (বিছিয়ে) তার উপর চারজানু হয়ে বসে
পড়ল। কেননা সে শিষ্টাচার বশত নিজ স্বামীর কাছে বসতে নিজের অধিকার আছে বলে মনে করত
না। সময় যাচ্ছে; কিন্তু সে (কোনো কথা না বলে) চুপচাপ বসে আছে। স্বামী তাকে কথা
বলার জন্য সম্বোধন করলে পরে সে কথা বলে। সাইয়েদের পিঠ সোফার গদিতে ঠেস দিল এবং
দীর্ঘ নৈশালাপের পর তাকে ক্লান্ত দেখাল। মদ্যপানের প্রভাবে দুই কোণে আকস্মিক লাল
বর্ণ প্রবাহিত হওয়া চোখের পাতাদুটি ভারী হয়ে এল এবং তিনি মাতাল দীর্ঘশ্বাস ফেলতে
লাগলেন।
যদিও তিনি প্রতি রাতে মদ্যপান করতেন এবং অতিমাত্রায় পান
করার কারণে মাতাল হয়ে যেতেন, কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত বাড়ি ফেরার মনস্থ করতেন না,
যতক্ষণ না মদের প্রভাব দূর হয়ে যেত এবং নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে আসত। আর এটা সেই
গাম্ভীর্য ও ভাবের আশায় যা তিনি বাড়িতে প্রকাশ পাওয়া পছন্দ করেন।
(রাত্রিজাগরণ) নৈশালাপের পর তার স্ত্রীই তার পরিবারের
একমাত্র সদস্য যার সাথে তার সাক্ষাৎ হয়; কিন্তু সে (স্ত্রী) ঘ্রাণ ছাড়া মদ্যপানের
আর কোনো নিদর্শন দেখতে পেত না।
--
অনুবাদক
আতহারুল ইসলাম শাহেদ মাজীদী
কোন মন্তব্য নেই